বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের কেন্দ্রীয় বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। বাজেট আলোচনায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। সংসদে বাজেট বিতর্কের জবাবে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানান, বিশ্বজুড়ে সংঘাত, অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং বাণিজ্যিক বিধিনিষেধের ফলে বাজেট প্রণয়ন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, ভারতের অর্থনীতি জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ৬.৪% হারে প্রকৃত এবং ৯.৭% হারে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে রয়েছে। বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে।বাজেটের প্রধান লক্ষ্য২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে এমনভাবে গঠন করা হয়েছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে, বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়াবে। বাজেটের প্রধান লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:§ কৃষি ও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প খাতের উন্নয়ন§ বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করা§ গ্রামীণ উন্নয়নের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা§ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বাড়ানো§ উৎপাদন খাত ও দেশীয় ভোক্তাব্যয় বৃদ্ধির উদ্যোগ§ অবকাঠামো উন্নয়নে টেকসই সরকারি ব্যয়§ বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার ও উদ্ভাবনী অর্থনীতি গড়ে তোলাবিভিন্ন খাতে বরাদ্দনতুন বাজেটে গুরুত্বপূর্ণ খাতসমূহের জন্য মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে:§ কৃষি ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম: ₹১.৭১ লাখ কোটি§ গ্রামীণ উন্নয়ন: ₹২.৬৭ লাখ কোটি§ শহর উন্নয়ন ও পরিবহন: ₹৬.৪৫ লাখ কোটি§ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা: ₹২.২৭ লাখ কোটি§ প্রতিরক্ষা (পেনশন ব্যতীত): ₹৪.৯২ লাখ কোটিসরকারের মতে, মোট মূলধনী ব্যয় জিডিপির ১৫.৪৮% পর্যন্ত পৌঁছাবে, যা ৪.৪% আর্থিক ঘাটতির প্রায় সমান। এর অর্থ হলো, ধার করা অর্থ মূলধনী প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করবে।রাজ্যগুলোতে বরাদ্দ বৃদ্ধিরাজ্যগুলোর জন্য বাজেট বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সমবায়ী কেন্দ্রীয়তন্ত্রের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে।§ ২০২০-২১: ₹১৩.৪৪ লাখ কোটি§ ২০২২-২৩: ₹১৫.৫৬ লাখ কোটি§ ২০২৩-২৪: ₹১৭.৯৮ লাখ কোটি§ ২০২৪-২৫: ₹২২.৯১ লাখ কোটি§ ২০২৫-২৬: ₹২৫.১ লাখ কোটিএতে রাজ্যগুলোর উন্নয়ন কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।আর্থিক সংস্কার ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি২০২১ সাল থেকে বাজেটে স্বচ্ছতা ও আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়ন করা হয়েছে:§ ২০২১: খাদ্য কর্পোরেশনের ₹১.২ লাখ কোটি টাকার বাজেট বহির্ভূত ঋণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।§ ২০২২: শহুরে গৃহায়ন খাতে ₹৩৩,০০০ কোটি টাকার বাজেট বহির্ভূত ঋণ নিয়মিত করা হয়।§ ২০২৩: রেলপথ ও মহাসড়কের মূলধনী ব্যয় কেন্দ্রীয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।§ ২০২৪: মধ্যবিত্ত শ্রেণির কর ছাড় দিতে নতুন করব্যবস্থা ডিফল্ট হিসেবে চালু করা হয়।§ ২০২৫: মন্ত্রণালয়গুলোকে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যাতে ব্যয়ের দক্ষতা বাড়ে।অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের পথ§ বেকারত্ব হ্রাস: ২০১৭-১৮ সালে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৪৯.৮%, যা ২০২৩-২৪ সালে বেড়ে ৬০%-এ পৌঁছেছে। বেকারত্বের হার ৬% থেকে কমে ৩.২%-এ নেমে এসেছে। ‘রোজগার মেলা’ কর্মসূচির মাধ্যমে ইতোমধ্যে ২৫ লাখ সরকারি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।§ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: খুচরা মূল্যস্ফীতি ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের ২-৬% সহনীয় মাত্রার মধ্যেই রয়েছে। সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে নিচের পদক্ষেপগুলো নিয়েছে: সাশ্রয়ী মূল্যে ‘ভারত ডাল’ সরবরাহ; কৌশলগতভাবে পেঁয়াজের মজুদ ব্যবস্থাপনা; উচ্চ ফলনশীল বীজ ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি।§ রুপি অবমূল্যায়ন: বিশ্বব্যাপী মুদ্রার ওঠানামার মধ্যেও ভারতীয় রুপির অবমূল্যায়ন তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাংক গভর্নর রঘুরাম রাজন উল্লেখ করেছেন, বর্তমান বৈশ্বিক প্রবণতার সাথেই রুপির মানের পরিবর্তন সামঞ্জস্যপূর্ণ।§ গৃহস্থালী সঞ্চয় ও ঋণ: ২০১৯-২০ সাল থেকে গৃহস্থালী সঞ্চয়ের বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৮.৯%। পাশাপাশি, বাস্তব সম্পদে বিনিয়োগের হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।§ সামাজিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি: বাজেটে বিভিন্ন সামাজিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।§ সামাজিক কল্যাণ: ₹৬০,৬৫২ কোটি (২০২৪-২৫ সালে ছিল ₹৫৬,৬৫১ কোটি)§ শিক্ষা: ₹১.২৯ লাখ কোটি (২০২৪-২৫ সালে ছিল ₹১.২৬ লাখ কোটি)§ স্বাস্থ্য: ₹৯৮,৩১১ কোটি (২০২৪-২৫ সালে ছিল ₹৮৯,৪৮৭ কোটি)এছাড়া, আগের বছরের কিছু অব্যবহৃত বরাদ্দও রয়েছে:§ মধ্যাহ্নভোজ কর্মসূচি (PM Poshan): ₹৫,৫২৫ কোটি§ স্বচ্ছ ভারত (শহর): ₹১২,৩১৯ কোটি§ জল জীবন মিশন: ₹১৩,৭৮০ কোটি§ মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট: ₹৪,৩৫১ কোটিভবিষ্যতের বাজেট কি সফল হবে?এবারের বাজেটের মাধ্যমে সরকার অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রবৃদ্ধির পথকে সুসংহত করেছে। উচ্চ মূলধনী ব্যয়, রাজ্যসমূহে সহায়তা বৃদ্ধি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার মাধ্যমে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধির ভিত্তি আরও মজবুত করা হচ্ছে।বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার মধ্যেও ভারতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সরকার ভবিষ্যৎ উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা উপস্থাপন করেছে। অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও সামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এবারের বাজেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক