নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার জরুরি প্রয়োজন বলে একমত পোষণ করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ
বুধবার, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছেন যে ভারত আগামী গ্লোবাল এআই সামিটের আয়োজক হবে। এই সিদ্ধান্ত এসেছে প্যারিসে আয়োজিত এআই অ্যাকশন সামিটের আলোচনার পর, যা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন তিনি।

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তারা বৈশ্বিক এআই খাতকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিত করতে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে অঙ্গীকার করেছেন।’

এই বিবৃতি প্রধানমন্ত্রী মোদীর তিন দিনের (১০-১২ ফেব্রুয়ারি) ফ্রান্স সফরের সময় প্রকাশিত হয়। এটি মোদির ষষ্ঠ ফ্রান্স সফর, যা প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর ভারত সফরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ভারতের ৭৫তম প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসেবে ভারতে এসেছিলেন ম্যাক্রোঁ।

এই সফরে দুই নেতা দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার পাশাপাশি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন।

মার্সেই সফর ও কনস্যুলেট উদ্বোধন

প্রধানমন্ত্রী মোদী ও প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ফ্রান্সের মার্সেই শহর সফর করেন, যেখানে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ তাকে ব্যক্তিগত নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। সফরের অংশ হিসেবে তারা মার্সেইতে ভারতের কনস্যুলেট জেনারেলের উদ্বোধন করেন এবং আন্তর্জাতিক থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিয়েক্টর (আইটিইআর) প্রকল্প পরিদর্শন করেন।

ভারত-ফ্রান্স কৌশলগত অংশীদারিত্ব

দুই নেতা ‘হরাইজন ২০৪৭ রোডম্যাপ’ অনুসারে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ফ্রান্স সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী  মোদী  বাস্টিল ডে উদযাপনে প্রধান অতিথি ছিলেন, যেখানে এই রোডম্যাপ প্রকাশিত হয়।

তারা সংস্কার ও কার্যকর বহুপাক্ষিকতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন, যা বিশ্বব্যাপী সমতা ও শান্তি রক্ষা এবং প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের আহ্বান

দুই নেতা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের জরুরি প্রয়োজন সম্পর্কে একমত হন এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ফ্রান্স আবারও ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ সমর্থনের নিশ্চয়তা দেয় এবং ভেটো ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা নিয়ে আলোচনা জোরদার করার বিষয়ে সম্মত হয়।

প্রতিরক্ষা খাতে ভারত-ফ্রান্স সহযোগিতা

ভারত ও ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা দুই নেতা তুলে ধরেন। বিশেষ করে ভারতের স্করপিন সাবমেরিন প্রকল্পে দেশীয় প্রযুক্তির সংযোজন নিয়ে আলোচনা হয়।

তারা ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন কর্তৃক নির্মিত এয়ার ইনডিপেনডেন্ট প্রপালশন প্রযুক্তি স্করপিন সাবমেরিনে যুক্ত করার পরিকল্পনা পর্যালোচনা করেন।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অংশ হিসেবে, ভারত ফরাসি সেনাবাহিনীকে পিনাকা মাল্টি-ব্যারেল রকেট লঞ্চার পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানায়।

পরমাণু জ্বালানিতে ভারত-ফ্রান্স অংশীদারত্ব

পরমাণু শক্তিকে টেকসই জ্বালানি হিসেবে গড়ে তুলতে উভয় দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশেষ করে জৈতাপুর পারমাণবিক প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে দুই নেতা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।

তারা স্মল মডুলার রিয়েক্টর (এসএমআর) ও অ্যাডভান্সড মডুলার রিয়েক্টর (এএমআর)-এ সহযোগিতার নতুন চুক্তিকে স্বাগত জানান এবং পারমাণবিক প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য ভারতের জিসিএনইপি ও ফ্রান্সের আইএনএসটিএন ও সিইএ-এর মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

পরিবেশ ও জলবায়ু সহযোগিতা

পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত ও ফ্রান্স যৌথ পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়। তারা ২০২৫ সালের জাতিসংঘ মহাসাগর সম্মেলনে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং বিবিএনজি চুক্তি দ্রুত কার্যকর করার আহ্বান জানান। ভারত-ফ্রান্স ইন্দো-প্যাসিফিক ত্রিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগিতা চালু করা হয়, যার মাধ্যমে জলবায়ু ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে কাজ করা হবে।

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ

২০২৪ সালে ভারত-ফ্রান্স বাণিজ্যে রেকর্ড প্রবৃদ্ধির কথা তুলে ধরে উভয় নেতা বাণিজ্য সম্প্রসারণের নতুন সম্ভাবনার ওপর জোর দেন। ‘৭ম চুজ ফ্রান্স সামিটে’ ভারত অতিথি দেশ হিসেবে অংশ নেয়, যা বিনিয়োগ আকর্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।

সংস্কৃতি ও শিক্ষা খাতে সহযোগিতা

ভারতের জাতীয় জাদুঘর ও ফ্রান্স মিউজিয়ামস ডেভেলপমেন্ট-এর মধ্যে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা জাদুঘর উন্নয়ন ও ভারতীয় পেশাদারদের প্রশিক্ষণে সাহায্য করবে।

২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক আয়োজনের সফলতার জন্য মোদি ম্যাক্রোঁকে অভিনন্দন জানান এবং ২০৩৬ সালে ভারত অলিম্পিক আয়োজনের আগ্রহ প্রকাশ করেন।

দুই নেতা রাইসিনা ডায়ালগের একটি আঞ্চলিক সংস্করণ মার্সেইতে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন, যা মেডিটেরিয়ান ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে।

ভারতীয় শিক্ষার্থীদের ফ্রান্সে পাঠানো বৃদ্ধি করতে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসেস স্কিম’ চালু করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০,০০০ ভারতীয় শিক্ষার্থী পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এছাড়া, ‘ইয়াং প্রফেশনালস স্কিম (ওয়াইপিএস)’ কার্যকর করা হয়েছে, যা ভারত-ফ্রান্সের তরুণ পেশাজীবীদের জন্য কর্মসংস্থান সুযোগ বৃদ্ধি করবে।

স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা

স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রথম প্রতিনিধি দল ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্যারিস সফর করে। তারা ডিজিটাল হেলথ, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ও স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের বিনিময়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

শেষ কথা

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফ্রান্স সফর ভারত-ফ্রান্স সম্পর্ককে আরও গভীর ও বহুমুখী করে তুলেছে। প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, পরিবেশ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি—সবক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরও জোরদার করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। এই সফর শুধু বর্তমান কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, বরং ভবিষ্যৎ ভারত-ফ্রান্স অংশীদারিত্বের শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক