জয়শঙ্কর শনিবার বলেছেন, নতুন মার্কিন প্রশাসনের আসন্ন শপথগ্রহণ “বৈশ্বিক ব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।”
নয়াদিল্লিতে নানি পালখিওয়ালা স্মারক বক্তৃতায় ড. জয়শঙ্কর বলেন, “এটি নিজেই একটি কারণ হিসেবে দেখার পরিবর্তে, এটিকে সেই পরিবর্তনের লক্ষণ হিসেবে বিশ্লেষণ করা উচিত যা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই প্রক্রিয়ার বহু মাত্রা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শক্তির পুনর্গঠন, যা বহু দশক ধরে চলমান।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও উল্লেখ করেন যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি একটি নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘকালীন বৈদেশিক নীতির ঐতিহ্য থেকে সরে এসে নিজস্ব স্বার্থে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে, বিশ্বকে গঠন করার পরিবর্তে।
তিনি বলেন, “আজকের বিশ্বে একীকরণ এবং বিচ্ছিন্নতার সহাবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে।”
এই প্রেক্ষাপটে তিনি ভারতের অনন্য অবস্থানকে তুলে ধরেন, যা একটি বহু-মেরুকেন্দ্রিক যুগে সমাধান প্রদানের জন্য প্রস্তুত।
ড. জয়শঙ্কর ভারতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সংস্কারকে বৈশ্বিক স্বস্তির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেন। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে ভারতের অবস্থান এবং শীঘ্রই তৃতীয় স্থানে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা তার ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে তুলে ধরে।
তিনি বলেন, “গণতন্ত্রে একটি সরকার যদি পরপর তিনবার ক্ষমতায় আসে, এটি অনেক কিছু সঠিকভাবে করার প্রমাণ।” তিনি উল্লেখ করেন যে এই স্থিতিশীলতা উচ্চাভিলাষী সংস্কার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করেছে, যা বৈশ্বিক মঞ্চে ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।
ড. জয়শঙ্কর ভারতের উৎপাদন, অবকাঠামো এবং ডিজিটাল রূপান্তরে দ্রুত অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেন, যা বৈশ্বিক দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ভারতের প্রস্তুতির পরিচায়ক। তিনি ভারতের দ্রুত বিকাশমান ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের উদাহরণ দেন, যেখানে মাসে কয়েক বিলিয়ন নগদবিহীন লেনদেন হচ্ছে এবং শক্তিশালী সেমিকন্ডাক্টর সক্ষমতা দেশটির সরবরাহ শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ড. জয়শঙ্কর জোর দিয়ে বলেন, “ভারত পশ্চিমা নয়, তবে এটি পশ্চিমবিরোধীও নয়।”
তিনি বহুমুখী শক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতার দ্বারা সংজ্ঞায়িত একটি বিশ্বে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। ভারত তার মূল স্বার্থের সঙ্গে আপস না করেই বন্ধুত্ব প্রসারিত করছে।
তিনি বহুবচনবাদ, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের মতো মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমমনোভাবাপন্ন দেশগুলোর সঙ্গে গভীর সহযোগিতার আহ্বান জানান। পাশাপাশি, এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন, যা ভারতের “বিশ্ববন্ধু” হিসেবে ভূমিকা পালনের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।
ড. জয়শঙ্কর ভারতের ভূ-অবস্থান এবং ঐতিহাসিক সুবিধাগুলোর ওপর ভিত্তি করে কূটনৈতিক কৌশলের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কোয়াড, ব্রিকস, এবং ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর-এর মতো আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক উদ্যোগে ভারতের নেতৃত্ব তুলে ধরেন।
বিশেষ করে তিনি ভারতের গ্লোবাল সাউথ-এর জন্য কণ্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকার কথা বলেন। 'গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠ' শীর্ষক সম্মেলন এবং ৭৮টি দেশে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে ভারত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে তার সুনাম প্রতিষ্ঠা করেছে।
ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব এবং কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কূটনীতি তার সামগ্রিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে।
ড. জয়শঙ্কর ভারতের চীনের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলেন।
তিনি পারস্পরিক সম্মান, সংবেদনশীলতা এবং স্বার্থের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। যদিও সীমান্ত বিরোধ এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে, তিনি চীনের ক্রমবর্ধমান সক্ষমতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।
বক্তৃতায় ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক নিয়েও আলোচনা করা হয়।
ড. জয়শঙ্কর “ভারত” নামের বৃহত্তর গ্রহণযোগ্যতাকে ভারতের সভ্যতাগত আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে 'মেক ইন ইন্ডিয়া'-এর মতো প্রোগ্রামগুলো অতীতের শিল্পায়ন হ্রাস পুনরুদ্ধার এবং প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যকে সমর্থন করে।
ড. জয়শঙ্কর একটি অনিশ্চিত বিশ্বে একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন।
তিনি উল্লেখ করেন যে, ক্লিন এনার্জি, মহাকাশ অনুসন্ধান, এবং ডিজিটাল গভর্ন্যান্সে ভারতের অগ্রগতি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
ড. জয়শঙ্কর বলেন, “ভারতের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব শুধুমাত্র ক্ষমতার গল্প নয় বরং দায়িত্বের গল্পও।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “একটি শক্তিশালী ভারত আরও বেশি অবদান রাখবে, বৃহত্তর দায়িত্ব পালন করবে এবং একটি আরও ভারসাম্যপূর্ণ বৈশ্বিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।” সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক