কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগকে স্বীকৃতি দিয়ে, ড. জয়শঙ্কর দক্ষ পেশাদারদের গতিশীলতা বাড়ানোর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্করের স্পেন সফর ভারত-স্পেন সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সাক্ষ্য বহন করেছে। দুই দিনের এই সফর (১৩-১৪ জানুয়ারি, ২০২৫) দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা, কৌশলগত সংলাপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের সম্প্রসারিত সম্পৃক্ততাকে তুলে ধরেছে। এই সফর এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এসেছে, যা কূটনৈতিক সম্পর্ককে মজবুত করার পাশাপাশি গভীরতর সহযোগিতার একটি রোডম্যাপ নির্ধারণ করেছে।
ড. জয়শঙ্করের জন্য এটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে স্পেনে প্রথম সফর, যা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভারত-স্পেন সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। সোমবার (১৩ জানুয়ারি, ২০২৫) মাদ্রিদে স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মানুয়েল আলবারেসের সঙ্গে বৈঠকে তিনি দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
“আজ স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মানুয়েল আলবারেসের সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা করতে পেরে আনন্দিত। আমাদের দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, নগর উন্নয়ন, রেলওয়ে, সবুজ হাইড্রোজেন, জলবায়ু পদক্ষেপ এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক। ভারত স্পেনকে শক্তিশালী ভারত-ইইউ সম্পর্কের সমর্থক এবং নির্ভরযোগ্য ভূমধ্যসাগরীয় অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে। খেলাধুলা এবং টেকসই নগর উন্নয়ন বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছি,” ড. জয়শঙ্কর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে উল্লেখ করেছেন।
একটি যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে, মন্ত্রী আলবারেস ভারত-ইইউ দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে সম্পর্ককে শক্তিশালী করার প্রতি উভয় পক্ষের প্রতিশ্রুতি জোর দিয়েছেন।
এই শীর্ষ সম্মেলনের লক্ষ্য দুই অঞ্চলের মধ্যে একটি নতুন কৌশলগত এজেন্ডা প্রতিষ্ঠা করা। আলোচনার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং টেকসই উন্নয়ন।
দুই মন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়, যা বর্তমানে প্রায় ১০ বিলিয়ন ইউরো। তারা অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করেন, যেখানে রেলওয়ে, ডিজিটাল প্রযুক্তি, নগর উন্নয়ন এবং পরিষ্কার জ্বালানি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। ড. জয়শঙ্কর স্পেনের আরও বেশি কোম্পানিকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘ডিজাইন ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। বর্তমানে ভারতে ২৩০টি স্পেনীয় কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে, যা সম্পর্কের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা। নেতারা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অর্জনগুলো নিয়ে আলোচনা করেন, যার মধ্যে রয়েছে সম্প্রতি সরবরাহকৃত সি২৯৫ সামরিক পরিবহন বিমান। উভয় পক্ষ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর এবং নৌবাহিনীর সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন, বিশেষত স্পেনের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে ড. জয়শঙ্কর দুই দেশের মধ্যে দক্ষ পেশাদারদের গতিশীলতা বাড়ানোর গুরুত্ব তুলে ধরেন। বার্সেলোনায় একটি নতুন ভারতীয় কনস্যুলেট এবং বেঙ্গালুরুতে স্পেনীয় কনস্যুলেট খোলার পরিকল্পনা এ বিষয়টিকে সহজতর করবে। এই পদক্ষেপ প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো ক্ষেত্রে প্রতিভা বিনিময় এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করতে সাহায্য করবে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ভারত এবং স্পেন ২০২৬ সালকে সংস্কৃতি, পর্যটন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বছর হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই উদ্যোগটি সামাজিক সম্পর্ককে গভীরতর করতে এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে সহযোগিতা বাড়াতে লক্ষ্য স্থির করেছে।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রতি ভারতের ক্রমবর্ধমান মনোযোগ
ড. জয়শঙ্করের বক্তব্যে ভারতের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রতি ক্রমবর্ধমান মনোযোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি ৮০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করে বন্দর, বিমানবন্দর এবং সম্ভাব্য সবুজ হাইড্রোজেন প্রকল্পে ভারতীয় বিনিয়োগ তুলে ধরেন। স্পেনের সমর্থন ভারতের ভূমধ্যসাগরীয় কৌশলকে মজবুত করবে, বিশেষ করে টেকসই উন্নয়ন এবং শক্তি রূপান্তরের অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিতে।
উভয় মন্ত্রী ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা এবং ইউক্রেন সংঘাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে মতবিনিময় করেন।
স্পেনের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নৌবাহিনীর ক্রমবর্ধমান ভূমিকা উল্লেখ করে ড. জয়শঙ্কর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে যৌথ প্রচেষ্টার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ইউক্রেনের ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনা হয়, যেখানে উভয় পক্ষ সংলাপ এবং শান্তির পক্ষে সমর্থন জানায়। এই আলোচনাগুলো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে উভয়ের প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরেছে।
G20 এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সহযোগিতার ইতিহাস পুনর্বিবেচনা করে উভয় পক্ষ বহুপাক্ষিকতায় গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন।
স্পেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী ভূমিকা উল্লেখ করে ড. জয়শঙ্কর আশা প্রকাশ করেন যে, স্পেনের সমর্থন ভারত-ইইউ সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে।
একটি নতুন ভারত-ইইউ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি শিগগিরই কার্যকর হতে যাচ্ছে, এবং স্পেনের সমর্থন এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে সহায়ক হবে। এই অংশীদারিত্ব বাণিজ্য, জলবায়ু কর্মসূচি এবং ডিজিটাল রূপান্তরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লক্ষ্য স্থির করেছে।
সফরের সময় দুটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বিস্তৃত ক্ষেত্রকে প্রতিফলিত করে। প্রথম চুক্তিটি খেলাধুলার ক্ষেত্রে সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে, যা ক্রীড়া বিনিময় এবং ক্রীড়া উন্নয়নকে উৎসাহিত করবে। দ্বিতীয় চুক্তিটি টেকসই নগর উন্নয়নের ওপর, যা নগর স্থিতিস্থাপকতা এবং সবুজ অবকাঠামোর জন্য সেরা অভ্যাস বিনিময়ের উপর জোর দেয়।
ড. জয়শঙ্কর স্পেনে ভারতীয় প্রবাসীদের সাথেও মতবিনিময় করেন এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সেতু হিসেবে ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্তিশালী করতে ভারতীয় সম্প্রদায়ের অবদানের কথা উল্লেখ করেন এবং প্রবাসীদের জন্য সরকারের উদ্যোগগুলো তুলে ধরেন।
সফর শেষে ড. জয়শঙ্কর ভারত-স্পেন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি অস্থির মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের মতো অংশীদারিত্ব – যা যৌথ মূল্যবোধ এবং অভিন্ন স্বার্থের ওপর প্রতিষ্ঠিত – স্থিতিশীলতার শক্তি হয়ে উঠতে পারে।”
এই সফর কেবল স্পেনের সঙ্গে ভারতের অংশীদারিত্বের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেনি, বরং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের আরও শক্তিশালী সম্পৃক্ততার জন্য একটি কৌশলগত ভিশনও প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিশ্ব যখন জটিল চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, ভারত ও স্পেনের সহযোগিতা স্থিতিশীলতা ও উন্নতির মাইলফলক হিসেবে প্রমাণিত হবে। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক