দেশে রাজতন্ত্র ফেরাতে রাজধানী কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ করেছেন নেপালের সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রর হাজার হাজার সমর্থক
কেশব প্রধান: দেশে রাজতন্ত্র ফেরাতে রাজধানী কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ করেছেন নেপালের সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রর হাজার হাজার সমর্থক। এ সময় তারা নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্রের মর্যাদাও ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান। বৃহস্পতিবার কাঠমান্ডুতে এমন বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এপি। এতে বলা হয়, বিক্ষোভকারীরা জাতীয় পতাকা দোলাতে থাকেন। সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রপন্থি স্লোগান দিতে থাকেন। তারা কাঠমান্ডুর পাশেই সমবেত হন। চেষ্টা করেন শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে প্রবেশের। কিন্তু দাঙ্গা পুলিশ তাদেরকে আটকে দেয়। বাঁশের লাঠি প্রয়োগ করে।

কাঁদানে গ্যাস এবং জলকামান ব্যবহার করে। এতে উভয় পক্ষে বেশ কিছু মানুষ আহত হয়েছেন। এই র‌্যালির আগে থেকেই শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ। তা সত্ত্বেও বিক্ষোভ থেকে স্লোগান দেয়া হয়- আমাদের জীবনের চেয়ে রাজা ও দেশকে বেশি ভালোবাসি। রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনো। প্রজাতন্ত্র বাতিল করো।

২০০৬ সালে কয়েক সপ্তাহে রাজপথে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তখনকার রাজা জ্ঞানেন্দ্র কর্তৃত্ববাদী রাজতন্ত্র বাতিল করতে বাধ্য হন। দেশে প্রচলন করেন গণতন্ত্র। দু’বছর পরে দেশটিতে একটি নির্বাচিত পার্লামেন্ট আসে। তারাই ভোটের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্রকে বিলুপ্ত এবং নেপালকে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। এর প্রধান করা হয় প্রেসিডেন্টকে। তখন থেকেই সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র বসবাস করছেন একজন সাধারণ নাগরিকের মতো। তার কোনো ক্ষমতা নেই। কোনো নিরাপত্তা নেই। তবু জনগণের মধ্যে এখনো তার কিছু সমর্থন আছে। কিন্তু সেই সমর্থনকে পুঁজি করে ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ নেই বললেই চলে।

আবার দেশকে সেই রাজতন্ত্রে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সারা দেশে তার সমর্থকরা বৃহস্পতিবার সমবেত হন। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে দুর্নীতি এবং ব্যর্থ প্রশাসন বলে অভিযুক্ত করেন তারা।

উল্লেখ্য, নেপালে যখন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই সময়ে দেশটি হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবেই পরিচিত ছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে নেপালকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করা হয়। পরে দেশের সংবিধানেও সেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নেপালিদের একাংশের দাবি, রাজতন্ত্র ফিরে এলে, হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে নেপাল আবার স্বীকৃতি পেলে দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ওলির দল প্রচণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে এই জনমতকে হাতিয়ার করে রাস্তায় নেমেছে।

নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হলে ফিরে দেখতে হবে দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস। ১৭৬৮ সালে সেখানে রাজতন্ত্র চালু হয়েছিল। ২০০১ সালে নেপালি রাজতন্ত্রের উপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে। রাজা বীরেন্দ্র-সহ রাজপরিবারের ন’জন সদস্যকে গুলি করে খুন করা হয়। এর পরে সিংহাসনে বসেন জ্ঞানেন্দ্র।

তাঁর বিরুদ্ধেও প্রজাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। দিনের পর দিন বিক্ষোভের মুখে ২০০৬ সালে অবশেষে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন রাজা জ্ঞানেন্দ্র। দু’বছরের মধ্যে রাজতন্ত্র উঠে যায় নেপাল থেকে। ২০১৫ সালে নেপালের সংবিধান তৈরি হয়। সংবিধান স্বীকৃত প্রধানমন্ত্রী হন কেপি ওলি। তিনি তিন বার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছেন। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত তিনি।

নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এসেছিলেন ওলি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিশ্রুতি মতো সময় পেরিয়ে গেলেও প্রচণ্ডকে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাননি। সেই সময়ে ওলির বিরুদ্ধে নেপালে ব্যাপক গণবিক্ষোভ হয়েছিল। পরে তাঁর সংসর্গ ত্যাগ করে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করেন প্রচণ্ড।

গণতন্ত্রে নতুন দেশ নেপাল। সবে তাদের হাতেখড়ি হয়েছে। রাজনীতির এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে তাই নেপালের মানুষ ক্ষুব্ধ। তারা পরিস্থিতির জন্য নতুন শাসনব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন। ২৪০ বছর ধরে যে শাসনব্যবস্থার সঙ্গে নেপালিরা পরিচিত, আবার সেই রাজতন্ত্রেই ফিরে যেতে চাইছেন অনেকে। নেপালে জোরালো হচ্ছে রাজতন্ত্রের দাবি। হিন্দু ধর্মের অনিশ্চয়তার জন্যও এই শাসনব্যবস্থাকে তাঁরা দায়ী করছেন। লেখক: প্রখ্যাত সাংবাদিক। খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক