ভারতের প্রেসিডেন্সিতে জি২০-এর মূলসুর ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ মানবতাবাদের মূলনীতিগুলোকে অবলম্বনে গৃহীত।
গত ১০ জানুয়ারি যখন ‘বেস্ট অরিজিনাল সং (সেরা মৌলিক গান)’-এর জন্য গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা করা হয়, তখন বিজয়ী সিনেমা ‘আরআরআর-এর জন্য করতালির গর্জন ভারত ও সারা বিশ্বে বহুগুণে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল।

এটি বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড়, সর্বাধিক ফলপ্রসূ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রাণবন্ত ঐতিহ্যের উদযাপনকেই শুধু নির্দেশ করে না, বরং ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতির ঐশ্বর্য ও গুণাবলিকেও সূচিত করে। কয়েক দশকের সংশয় থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বমঞ্চে ভারত একটি বিশিষ্ট অবস্থানে পৌঁছানোর লগ্নে এই বিজয়কে ইন্ডিয়া@৭৫-এর জন্য একটি নতুন মুহূর্ত, সফট পাওয়ার রেনেসাঁর উদযাপন বলে মনে হচ্ছে।

জোসেফ নাইয়ের মতে, সফট পাওয়ার একটি দেশের তিনটি উপাদানের ওপর নির্ভর করে-এর আকর্ষণীয় সংস্কৃতি, লালিত রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং নৈতিক কর্তৃত্ব বিশিষ্ট পররাষ্ট্রনীতি; যা অন্যান্য দেশের কাছে ন্যায়সংগত। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে জবরদস্তি বা অর্থ প্রদানের পরিবর্তে আকর্ষণ ও প্রভাবের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অন্বেষণ করে। প্রধানমন্ত্রী মোদি সচেতনভাবে বিশ্বমঞ্চে ভারতের সভ্যতাবিষয়ক অবস্থার ধারণা তুলে ধরেছেন এবং বিশ্বব্যাপী তার সম্পৃক্ততার কৌশলে ভারতের গৌরবময় সফট পাওয়ারের জোয়ারকে আরও বেগবান করার চেষ্টা করেছেন।

তিনি যেমন জোর দিয়ে বলেন, ‘ভারত কেবল একটি জাতি নয়, এটি একটি চিন্তাধারা এবং একটি সংস্কৃতিও।’ অন্যান্য সভ্যতা থেকে আলাদা, ভারতীয় সভ্যতা হলো অন্যতম প্রাচীন, সর্ববৃহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতাগুলোর মধ্যে একটি, যা তার গৌরবময় অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এটি একটি অনন্য, আত্তীকরণমূলক এবং সর্বজনীন সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, যা ঐতিহাসিক অঞ্চলের গণ্ডি, ভাষা ভিত্তিক জাতিগত গোষ্ঠী ও শাসনপদ্ধতির বাইরে সম্প্রসারিত হয়েছে।

পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো এই জ্ঞানবৃক্ষ থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক ও অতীন্দ্রিয় চিন্তাধারার বিভিন্ন শাখা উৎপন্ন হয়েছে, যা ভারতে দৈনন্দিন জীবনকে পরিচালনা করে। ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিনির্ধারণের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী জনকল্যাণে সেগুলোর স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে।

২০২৩ সালে ভারতের প্রেসিডেন্সিতে জি২০-এর মূলসুর ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ মানবতাবাদের মূলনীতিগুলোকে অবলম্বন করে গৃহীত। বৈশ্বিক প্রাধান্যের ইস্যুতে, বিশেষ করে গান্ধীজির সর্বোদয় ও অন্ত্যোদয়-এর চেতনায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষযয়ে ভারতের আত্মবিশ্বাস ও কর্মকাণ্ড প্রশংসিত হচ্ছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি, আবাসন, খাদ্য, সবার জন্য জ্বালানি বা ডিজিটাল ও ফাইনান্সিয়াল ইনক্লুশন এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মিশনগুলোর ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মোদির দৃষ্টিভঙ্গি এমন সমাধানের পথপ্রদর্শন করেছে, যা বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের দেশগুলোর ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য।

‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ অ্যাওয়ার্ড’-এর বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে সবুজ উন্নয়ন, পরিবেশবিষয়ক মিশনের জন্য জীবনধারা ও জলবায়ুসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তার পঞ্চামৃত অ্যাকশন প্ল্যানের উদ্দেশ্যগুলোকে সমর্থন করার জন্য ভারতের গভীর প্রত্যয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন। এটি এখন ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সির একটি অগ্রাধিকারভিত্তিক মূলসুর। জলবায়ুবিষয়ক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে তার নেতৃত্ব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছ থেকে সমানভাবে প্রশংসা অর্জন করেছে। একইভাবে, ভারতের ভ্যাকসিন মৈত্রী, স্বাস্থ্যবিষয়ক সহযোগিতা এবং মানবিক সহায়তাও প্রশংসা পেয়েছে।

অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক ব্যবস্থা পুনর্গঠিত হওয়ায় মোদি সরকার আরও বিস্তৃত পটভূমিতে ভারতের সফট পাওয়ারকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে একটি ইতিবাচক ভারতের আখ্যান উপস্থাপন করতে এবং বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ‘এখন যুদ্ধের সময় নয়’ এবং ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ দর্শনের প্রচার আন্তর্জাতিক মহলকে আকৃষ্ট করেছে। সফট পাওয়ার ভারতের সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার পরিপূরক ও মূলধারায় সংযুক্ত। আমাদের কৌশলগত সংস্কৃতিতে একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ভারতের সফট পাওয়ারকে জনপ্রিয় করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

যোগ (ইয়োগা) নিশ্চিতভাবেই ভারতের সফট পাওয়ারের সবচেয়ে সফল বাহক হয়ে উঠেছে। জাপান থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব থেকে শুরু করে ব্রাজিল পর্যন্ত যোগব্যায়াম তথা যোগমন্ত্রের প্রতিধ্বনি একটি বৈশ্বিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে! ১৭৫টি সদস্যরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সমর্থনে ২১ জুনকে ‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’ হিসাবে নির্ধারণ করার জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবনা যোগের সর্বজনীন আবেদনের সাক্ষ্য দেয়। আয়ুর্বেদ, সৌন্দর্য ও সুস্থতা এবং ভারতীয় খাবারের স্বাদযুক্ত প্যালেট বিশ্বকে মোহিত করেছে। দীপাবলিও দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বজনীন উৎসবে পরিণত হচ্ছে।

ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলো সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য রপ্তানি হিসাবে কাজ করে এবং বিশ্বব্যাপী চালচলনের প্রচলক ও ট্রেন্ডসেটার হিসাবেও প্রভাব বিস্তার করে। রাজ কাপুর ও সত্যজিৎ রায় চিরকালের জন্য চলচ্চিত্রের জগৎকে রূপায়িত করেছেন। অমিতাভ বচ্চন, রজনীকান্ত, হৃতিক রোশন, আমির খান, শাহরুখ খান, প্রভাস ও রামচরণের মতো অভিনেতাদের ভক্ত/গুণগ্রাহী ছড়িয়ে রয়েছে এশিয়া, আরব ও আফ্রিকান দেশগুলো ছাড়াও ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাতেও। ইন্টারনেট, ইউটিউব, ওটিটি ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমগুলো ভারতীয় গল্প, শাস্ত্রীয় ও আধুনিক সংগীত এবং নৃত্যের জনপ্রিয়তাকে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিয়েছে। ডিজাইন, টেক্সটাইল, ফ্যাশন, পেইন্টিং, ভাস্কর্য, কারুশিল্প, স্থাপত্য, ভাষাসমূহ ও সাহিত্যসহ ভারতের বিস্তৃত সৃজনশীল শিল্পগুলো তাদের অকৃত্রিম ও সমৃদ্ধ নান্দনিকতা, অভিরুচিবিষয়ক সংবেদনশীলতা এবং ফিউশনযোগ্যতার কারণে প্রশংসিত ও চর্চিত।

ভারত তার অন্তর্নিহিত বুদ্ধিবৃত্তিক পুঁজি ও উদ্যোক্তাবাদী প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে এআই ব্যবহার করে দেশকে বিশ্বব্যাপী জ্ঞান, আইসিটি এবং ক্রমবর্ধমানভাবে প্রযুক্তি ৪.০ সক্ষমতা বিশিষ্ট অবস্থানের পুরোভাগে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পশ্চিমের অনেক বড় শিল্প ও প্রযুক্তি নেতৃত্ব ভারতীয় বংশোদ্ভূত, যা মোটেই আশ্চর্যজনক নয়। ভারত আজ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল উদ্যোক্তা বাস্তুতন্ত্র। ভারতের উদীয়মান অর্থনীতির গল্পটি বাণিজ্য, ভ্রমণ ও পর্যটনের মাধ্যমে বিশ্বের প্রতিটি কোণে তার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষে-মানুষে সংযোগের পাশাপাশি বিকাশমান ৩২ মিলিয়ন অভিবাসীর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। প্রতিবছর ২.৫ মিলিয়ন ভারতীয় বিদেশে পাড়ি জমায়, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

ভারতের সফট পাওয়ার সমগ্র গণতন্ত্রের জননী হিসাবে এবং বিশ্বের বৃহত্তম, বহুত্ববাদী ও সহনশীল গণতন্ত্র হিসাবে তার ঐকমত্য বিনির্মাণ, সহযোগিতামূলক ও পারস্পরিক সুবিধাপ্রদানের নীতিগুলোর ক্ষেত্রে তীক্ষ্ণ নজর দিয়েছে, যা জাতিসংঘেরও আদর্শ। এই দৃষ্টিভঙ্গি কিছু স্বৈরাচারী বৃহৎ শক্তির সম্পূর্ণ বিপরীতে, যারা তাদের জবরদস্তিমূলক শক্তি ব্যবহার করে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করে, যার জন্য অন্য জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয়।

প্রচলিত ধারণা ও ব্যবস্থার এই যুদ্ধে ভারতের জয়লাভ করাটা অপরিহার্য। কারণ, এটি ভারতের নিজস্ব টেকসই উন্নয়ন মডেল ও ভারতীয় পদ্ধতির সাফল্যকে চিত্রিত করে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয়।

২০২২ সালের মে মাসে কোয়াড সামিট চলাকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বলেছিলেন, অতিমারি মোকাবিলায় ভারত দেখিয়ে দিয়েছে যে ‘গণতন্ত্রও চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম’, এবং ‘স্বৈরাচারীরা দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বকে আরও ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারে’-এই জনশ্রুতিকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে।

বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের দেশগুলো আশা করে, ভারত সহযোগিতামূলক উন্নয়নের একটি মডেলকে আরও শক্তিশালী করবে, যা কূটনীতিকে শূন্য-অঙ্কের খেলায় নামতে দেবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘বিশ্ব গর্ব ও প্রত্যাশা নিয়ে ভারতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে...ভারতের মাটিতেই সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজছে। বিশ্বের এই পরিবর্তন, জগৎ নিয়ে চিন্তাধারা আমাদের ৭৫ বছরের অভিজ্ঞতাভিত্তিক অভিযাত্রার সুফল।’

ভারত সুসম্পাদিত সরকারি প্রচেষ্টার মাধ্যমে অভীষ্ট সুফল অর্জন করছে এবং ‘ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া’র সফট পাওয়ার কাজে লাগিয়ে অনেক ফলও পাচ্ছে। ২০৪৭ সালের মধ্যে ৪০ ট্রিলিয়নের অর্থনীতি হয়ে ওঠার লক্ষ্যে জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশের বিশাল সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে, সবচেয়ে বড় যুব ও নারী শক্তির আধার, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা সঙ্গে নিয়ে ভারত একটি নেতৃস্থানীয় শক্তি হওয়ার পথে রয়েছে।

দেশটির ক্রমবর্ধমান সফট পাওয়ার নিশ্চিত করবে যে এই উত্থান হবে সৌম্য, কল্যাণকর ও শান্তিপূর্ণ, যা একটি গণতান্ত্রিক, টেকসইভিত্তিতে উন্নত ও নিয়মনির্ভর বিশ্বব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। ভারতের দূরদর্শী এই চিন্তার নেতৃত্ব স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে শক্তি অর্জন করে, যিনি পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, ‘ভারত মাতার সেই মাতৃদেবী রূপ, যিনি আবার বিশ্বগুরু হবেন ও বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবেন।’

লক্ষ্মী পুরি, অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিক, জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব, ইউএন উইমেনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক। খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক